বানোয়াট ও মিথ্যা বা জাল হাদীস -২

যে ব্যাক্তির সালাত (নামায/নামাজ) তাঁকে তাঁর নির্লজ্জ ও অশোভনীয় কাজ হতে বিরত করে না, আল্লাহর নিকট হতে তাঁর শুধু দূরত্বই বৃদ্ধি পায়। হাদীসটি বাতিল।
যদিও হাদীসটি মানুষের মুখে মুখে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে তবুও সেটি সনদ এবং ভাষা ও উভয় দিক দিয়েই সহীহ নয়।
সনদ সহীহ না হওয়ার কারনঃ হাদীসটি তাবারানী “আল-মুজামুল কাবীর” গ্রন্থে (৩/১০৬/২), কাযাঈ “মুসনাদুশ শিহাব” গ্রন্থে (২/৪৩) এবং ইবনু আবী হাতিম বর্ণনা করেছেন, যেমনটি “তাফসীর ইবনু কাসীর” গ্রন্থে (২/৪১৪) এবং “আল কাওয়াকাবুদ দুরারী” গ্রন্থে (৮৩/২/১) লাইস সূত্রে তাউস এর মাধ্যমে ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে।
এ লাইসের কারণে হাদীসটির সনদ দুর্বল – তিনি হচ্ছেন লাইস ইবনু আবী সুলাইম- কারন তিনি দুর্বল বর্ণনাকারী।
হাফিয ইবনু হাজার “তাকরীবুত তাহযীব” গ্রন্থে তার জীবনী লিখতে গিয়ে বলেনঃ তিনি সত্যবাদী, কিন্তু শেষ জীবনে তার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছিল। তার হাদীস পৃথক করা যেত না, ফলে তার হাদীস মাতরূক (অগ্রহণযোগ্য)।
হায়সামী “মাজমা’উয যাওয়াঈদ” গ্রন্থে (১/১৩৪) একই কারন উল্লেখ করেছেন। তার শাইখ হাফিয আল-ইরাকী “ তাখরীজুল ইহইয়া” গ্রন্থে (১/১৪৩) বলেছেনঃ হাদীসটির সনদ লাইয়েনুন (দুর্বল)।
আমি (আলবানী) বলছিঃ হাদীসটি ইবনু জারীর তার “তাফসীর” গ্রন্থে (২০/৯২) ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে অন্য সূত্রে মওকুফ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। সম্ভবত এটই  সহীহ অর্থাৎ সাহাবীর কথা। যদিও তার সনদে এমন ব্যক্তি রয়েছেন যার নাম উল্লেখ করা হয়নি।
ইমাম আহমাদ “কিতাবুল যুহুদ”  গ্রন্থে (পৃঃ ১৫৯) আত তাবারানী “মু’জামুল কাবীর” গ্রন্থে হাদীসটি ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে মওকুফ হিসাবে ভিন্ন ভাষায় বর্ণনা করেছেন।
হাফিয ইরাকী বলেনঃ তার সনদটি সহীহ। অতএব হাদীসটি মওকুফ।
ইবনুল আ’রাবী তার “আল-মু’জাম” গ্রন্থে (১/১৯৩) হাদীসটি হাসান বাসরী হতে মুরসাল হিসাবে বর্ণনা করেছেন। হাসান হচ্ছেন মুদাল্লিস।
হাফিস যাহাবী “মীযানুল ই’তিদাল” গ্রন্থে বলেনঃ
তিনি বেশী বেশী তাদলীস করতেন। তিনি আন শব্দে বর্ণনা করলে তার হাদীস দ্বারা দলীল গ্রহণ করাটা দুর্বল হয়ে যায়। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে তার শ্রবন সাব্যস্ত হয়নি। এ কারনে মুহাদ্দিসগণ আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে তার হাদীসকে মুনকাতি’ হিসাবে গণ্য করেছেন।
তবে হাসান বাসরীর নিজের কথা হিসাবে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। তিনি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন এমন কথা বলেননি। ইমাম আহমাদ “আল-যুহুদ” গ্রন্থে (পৃঃ ২৬৪) এভাবেই বর্ণনা করেছেন আর তার সনদটি সহীহ। অনুরূপভাবে ইবনু জারীরও বিভিন্ন সূত্রে তার থেকেই (২০/৯২) বর্ণনা করেছেন এবং এটই সঠিক।
“মুসনাদুস শিহাব” গ্রন্থে (২/৪৩) মিকদাম ইবনু দাউদ সূত্রে হাসান বাসরী হতে মারফূ’’ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে।
কিন্তু এই মিকদাম সম্পর্কে নাসাঈ বলেনঃ তিনি নির্ভরযোগ্য নন।
মোটকথা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত এটির সনদ সহীহ নয়। ইবনু মাসউদ (রাঃ) এবং হাসান বাসরী হতে সহীহ সনদ বর্ণিত হয়েছে। ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতেও বর্ণনা করা হয়েছে।
এ কারণেই ইবনু তাইমিয়্যা “কিতাবুল ঈমান” গ্রন্থে (পৃঃ১২) মওকুফ হিসাবেই উল্লেখ করেছেন।
ইবনু উরওয়াহ্‌ “আল-কাওয়াকিব” গ্রন্থে বলেছেনঃ এটই বেশী সঠিক।
ভাষার দিক দিয়ে সহীহ না হওয়ার কারনঃ
হাদীসটি যে ব্যক্তি সালাতের শর্ত এবং আরকান সমূহের দিকে যত্নবান হয়ে যথাযথভাবে আদায় করে সে ব্যক্তিকেও সম্পৃক্ত করে। অথচ শারী’আত তার সালাতকে বিশুদ্ধ বলে রায় প্রদান করেছে। যদিও এ মুসল্লি কোন গুনাহের সাথে জড়িত থাকে। অতএব কিভাবে এ সালাতের কারনে তা সাথে আল্লাহর দূরত্ব বৃদ্ধি পাবে? এটি বিবেক বর্জিত কথা। শারী’আত এ কথার সাক্ষ্য দেয় না। হাদীসটি মওকুফ হওয়ার ক্ষেত্রেও সালাত দ্বারা এমন সালাতকে বুঝানো হয়েছে যে সালাতে এমন কোন অংশ ছেড়ে দেয়া হয়েছে যা ছেড়ে দিলে সালাত শুদ্ধ হয় না।
আল্লাহ্‌ বলেনঃ অর্থ ‘নিশ্চয় সালাত নির্লজ্জ ও অশোভনীয় কাজ হতে বিরত রাখে ’ (আনকাবুতঃ৪৫)
রাসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল অমুক ব্যক্তি সারা রাত ধরে  ইবাদাত করে অতঃপর যখন সকাল হয় তখন সে চুরি করে! উত্তরে তিনি উক্ত আয়াতের গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেনঃ
‘তুমি যা বলছ তা থেকেই অচিরেই তাকে তার সালাত বিরত করবে অথবা বলেনঃ তাকে তার সালাত বাধা প্রদান করবে’
হাদীসটি ইমাম আহমাদ, বায্‌যার, তাহাবী “মুশকিল আসার” গ্রন্থে (২/৪৩০), বাগাবী “হাদীসু আলী ইবনুল যা’আদ” গ্রন্থে (৩১/১/৬৯/১) সহীহ্‌ সনদে আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন।
লক্ষ্য করুন! রাসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন যে, এ ব্যক্তি তার সালাতের কারনে চুরি করা হতে বিরত থাকবে (যদি তার সালাতটি যথাযথ ভাবে হয়)। তিনি বলেননি যে, তার দূরত্ব বৃদ্ধি করবে, যদিও সে তার চুরি হতে বিরত হয়নি। এ কারনেই আব্দুল হক ইশবীলী “আত-তাহাজ্জুদ” গ্রন্থে (কাফ-১/২৪) বলেনঃ
সত্যিকার অর্থে যে ব্যক্তি সালাত আদায় করবে এবং সালাতকে আঁকড়ে ধরে রাখবে, তার সালাত তাকে হারামে জড়িত হওয়া এবং হারামে পতিত হওয়া থেকে বিরত রাখবে।
অতএব প্রমাণিত হচ্ছে যে, হাদীসটি সনদ এবং ভাষা উভয় দিক দিয়েই দুর্বল।
এ ছাড়া আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইয্‌যুদ্দ্বীন ইবনু আব্দিস সালাম ইবনু আব্বাস (রাঃ) এর আসারটি উল্লেখ করে বলেছেনঃ এ ধরনের হাদীসকে ভীতি প্রদর্শনমূলক হাদীস হিসাবে গণ্য করা বাঞ্ছনীয়।
এ হাদীসকে তার বাহ্যিক অর্থে নেয়া ঠিক হবেনা। কারন তার বাহ্যিক অর্থ সহীহ হাদীসে যা সাব্যস্ত হয়েছে তার বিপরীত অর্থ বহন করছে। সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে যে, সালাত গুনাহ সমূহকে মোচন করে, অতএব আল্লাহর সাথে দূরত্ব বৃদ্ধি করলে সালাত কিভাবে গুনাহ মোচনকারী হতে পারে?
আমি (আলবানী) বলছিঃ এরূপ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে তবে মওকুফ হিসাবে গণ্য করে, রাসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বানী হিসাবে নয়।
উপরের আলোচনার সাক্ষ্য দেয় বুখারীতে বর্ণিত হাদীস। একব্যক্তি কোন মহিলাকে চুমু দিয়ে দেয়। অতঃপর সে রাসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট ঘটনাটি উল্লেখ করলে আল্লাহ্‌ তা’আলা নিম্নোক্ত আয়াতটি নাযিল করেনঃ
‘নিঃসন্দেহে সৎ কর্মগুলো অসৎ কর্মগুলোকে মুছে ফেলে’ (হুদঃ ১১৪)
হাফিয যাহাবী “আল-মীযান” গ্রন্থে (৩/২৯৩) ইবনুুয যুনায়েদ হতে বর্ণনা করে (আলোচ্য) হাদীসটি সম্পর্কে বলেনঃ এটি মিথ্যা।


হাদিসের মানঃ  জাল (Fake)

Comments

Popular posts from this blog

তিনটি বিশ্বাস সকল ধর্মের মানুষ-ই মানত

কর্মের মাধ্যমে কালেমার অর্থ পরিবর্তন

উম্মাহ